টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ-
টাঙ্গুয়ার হাওর (Tanguar Haor) সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ১০০ বর্গ কি.মি পর্যন্ত বিস্তৃত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার অংশ বিশেষ নিয়েই এ হাওরের অবস্থান। হাওর অঞ্চলের গ্রামগুলো যেন এক একটি দ্বীপ। হাওরের চারপাশে রয়েছে ৮৮টি গ্রাম। ‘ছয় কুড়ি বিল আর নয় কুড়ি কান্দার’ সমন্বয়ে পরিচিত দৃষ্টিনন্দন এ বিলটি। যার দৈর্ঘ্য ১১ এবং প্রস্থ ৭ কিলোমিটার। টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন ৬৯১২ একর। তবে বর্ষাকালে এই হাওরের আয়তন বেড়ে প্রায় ২০,০০০ একর পর্যন্ত হয়ে যায়।
অথৈ পানি, জলাবন,নীল আকাশ, পাহাড়, ও চোখ জুড়ানো সবুজ টাঙ্গুয়ার হাওরকে অপরূপ সাজে সাজিয়েছে। কখনো আকাশের মতো নীল, কখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ—এমন স্নিগ্ধ রঙে রাঙা পানিতে টইটুম্বর হাওর-বাঁওড়। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝর্না থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, অগণিত পাখির কলতান আর করচ-হিজল বনের অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যাবে শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরেই। টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ৫১টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত। কিছু বছর আগেও এই হাওরে যাওয়া ও থাকা দুটিই ছিল যথেষ্ট দুঃসহ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য ও চাহিদার কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়া ও থাকা দুটিই হয়ে গেছে বেশ আরামদায়ক।
বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল অঞ্চল চেরাপুঞ্জির কাছেই অবস্থিত রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর। সরকার ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরের ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকাকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে। হাওরটি দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট এবং পৃথিবীর ১০৩১তম রামসার সাইটের মর্যাদা পায় ২০০০ সালে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ এবং ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপের সন্ধান পাওয়া যায়। শীতকালে এই হাওরে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির বিচরণ ঘটে। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে এখানে একটি সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়গুলো দেখা যায়। মেঘালয় থেকে ছোট-বড় ঝর্না হাওরে এসে মিশেছে। এই হাওরে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের গ্রামগুলো ভাসমান দ্বীপের মতো দেখায়।
টাঙ্গুয়ার হাওর এর দর্শনীয় স্থান
প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে পুরো হাওরটাই দর্শনীয়। তবে হাওরে রয়েছে ছোট ছোট সোয়াম্প ফরেস্ট। এছাড়া নীলাদ্রি লেক, লাকমাছড়া, বারিক্কা টিলা, শিমুল বাগান, লাউয়ের গড়, ওয়াচ-টাওয়া, যাদুকাটা নদী। হাওরে সূর্যাস্ত অসাধারণ। চাঁদনী রাতে মাতাল জোসনা বাউলা বাতাস আপানকে মাতাল করে তুলবে।।
বাংলাদেশে যত দর্শনীয় স্থান আছে তা দক্ষিন এশিয়ার কোথাও না কোথাও আছে। একমাত্র টাঙ্গুয়ার হাওর এর মতো বৈচিত্র্যময় স্থান কোথাও নেই। তাই বিদেশি কোনো পর্যটক বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানের নাম জানতে চাইলে টাঙ্গুয়ার হাওরের নাম সাজেস্ট করতে বলে ট্রাভেল এক্সপার্টরা।
টাঙ্গুয়ার হাওরে কখন যাবেন
অকৃত্তিম সৌন্দর্যের আধার টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল। এসময় বৃষ্টির পানিতে সব গাছপালা সতেজ রূপ ধারণ করে, তৈরি হয় এক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। তবে অতিথি পাখি দেখার জন্য আপনাকে যেতে হবে শীতকালে। যদিও এসময় হাওরে পানির পরিমাণ অনেক কম থাকে কিন্তু সৌন্দর্যের কোন ঘাটতি থাকে না তখনো।
টাঙ্গুয়ার হাওরে কীভাবে যাবেন
টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে প্রথমেই আপনাকে যেতে হবে সুনামগঞ্জ। ঢাকা থেকে সড়কপথে সুনামগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ২৬৬ কিলোমিটার। ঢাকার সায়েদাবাদ এবং মহাখালী বাস-টার্মিনাল থেকে হানিফ, এনা, শ্যামলী সহ বেশ কিছু এসি ও ননএসি বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সুনামগঞ্জ গিয়ে পৌঁছাতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। এরপর সুনামগঞ্জ বাস-টার্মিনাল থেকে রিকশায় করে সাহেববাজার ঘাট পর্যন্ত যেতে হবে। বর্ষার সময় সাহেব বাড়ি ঘাট থেকে সরাসরি স্পীড বোটে ২ ঘণ্টায় টাঙ্গুয়া যাওয়া সম্ভব। তবে ইঞ্জিন বোটে এরচেয়ে কম খরচে যাওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ৫ ঘণ্টা। সিলেট থেকেও সুনামগঞ্জ যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনার প্রথমেই যেতে হবে কুমারগাও বাসস্ট্যান্ড সেখান থেকে সুনামগঞ্জের বাসের টিকেট জনপ্রতি ১০০ টাকা। সুনামগঞ্জ শহরের কিছুটা আগে সুরমা সেতু থেকে আপনি যেতে পারবেন লেগুনা অথবা মোটরসাইকেলে করে একেবারে তাহিরপুর পর্যন্ত। এক্ষেত্রে বাইকে জনপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকা এবং লেগুনাতে ৫০-৬০ টাকা।
নৌকায় থাকার বিস্তারিত
চারিদিকে থৈথৈ পানি, আর আকাশ ভরা তারা, কোথাও নেই কোন কোলাহল, যেন ভিন্ন এক দুনিয়াতে চলে এসেছেন আপনি। এরকম কিছু অভিজ্ঞতা দিতে আপনাকে কিছুটা সাহস করে নৌকা ভাড়া করে রাত যাপন করতে হবে। কেননা টাঙ্গুয়ার হাওরের রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে নৌকায় থাকার কোন বিকল্প নেই। নৌকা ভাড়া করতে চাইলে অবশ্যই কিছু জিনিস মাথায় রাখবেন যেমন নৌকায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে মোবাইল চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা, লাইট ফ্যানের সুব্যবস্থা আছে কিনা এবং সবচেয়ে গুরুত্তপুর্ন বাথরুম আছে কিনা। এসব সুবিধা যেসব নৌকায় আছে তারা সাধারণত একটু বেশি ভাড়া দাবী করে থাকে তবে দামাদামি করলে কিছুটা কমে রফা হয়।নৌকায় কোন খাবার ব্যবস্থা থাকে না, তাই আপনি নিজেই রান্না করতে পারেন অথবা সাথে করে ভাড়ায় একজন বাবুর্চি নিয়ে যেতে পারেন। নৌকায় লাইফ জ্যাকেট না থাকলে আপনি নিকটস্থ তাহিরপুর বাজার থেকে ভাড়ায় লাইফ জ্যাকেট সাথে নিতে পারবেন।
কোথায় খাবেন
টাঙ্গুয়ার হাওর এর তাহিরপুর ও টেকেরঘাটে কয়েকটি খাবার হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে হাওরের সুস্বাদু মাছ,হাসঁ, ভর্তা, ইত্যাদি দিয়ে দুপুর ও রাতের খাবার খেতে পারবেন। আর নিজেরা রান্না করতে চাইলে তাহিরপুর বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে উঠতে হবে নৌকায়।লোকজন বেশি হলে মাঝিকে বলে একজন বাবুর্চি নিতে পারবেন বোটে।
কোথায় থাকবেন
টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকার জন্য দুই ধরণের ব্যবস্থা আছে। আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তবে আপনার জন্য রয়েছে নৌকায় থাকার ব্যবস্থা। অন্যদিকে পরিবার পরিজন নিয়ে গেলে আপনি থাকতে পারেন হাওর বিলাশ নামের কাঠের বাড়িতে যা কিনা হাওর সংলগ্ন টেকেরহাটে অবস্থিত। এখানে আপনি স্বল্প ভাড়ায় পেয়ে যাবেন রুম। এছাড়া টেকেরঘাট বাজারে একটি মোটামোটি মান সম্মত হোটেল রয়েছে। তবে টুরিস্ট সিজনে গেলে রুম পাওয়া কিছুটা দুরহ। এর বাইরে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আর কোন থাকার ব্যবস্থা নেই এখানে। তবে সুনামগঞ্জে আপনি ৫০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন একাধিক রেস্ট হাউজ।
বি: দ্র : ঘুরতে গিয়ে দয়া করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না,চিপস এর প্যাকেট, পানির বোতল এবং অপচনশীল দ্রব্য নির্ধারিত স্হানে ফেলুন।। এই পৃথিবী, আমার, আপনার সুতরাং নিজের দেশ এবং পৃথিবীকে সুন্দর রাখা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বও আমার এবং আপনার হ্যাপি_ট্রাভেলিং
ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য পেতে জয়েন করুন আমাদের ফেইসবুক গ্রুপ এবং ফলো করুন আমাদের পেইজ
 
                     
     
                                    
Comment (0)